মুরজিয়া বিভ্রান্তি ও আহলুস সুন্নাতের আকীদা





ইমাম আ’যম আবূ হানীফা নু’মান ইবন সাবিত (রাহ) বলেন:
وَلاَ نَقُوْلُ: إِنَّ الْمُؤْمِنَ لاَ يَضُرُّهُ الذُّنُوْبُ، وَلاَ نَقُوْلُ: إِنَّهُ لاَ يَدْخُلُ النَّارَ، وَلاَ نَقُوْلُ: إِنَّهُ يَخْلُدُ فِيْهَا، وَإِنْ كَانَ فَاسِقاً بَعْدَ أَنْ يَخْرُجَ مِنَ الدُّنْيَا مُؤْمِناً. وَلاَ نَقُوْلُ: إِنَّ حَسَنَاتِنَا مَقْبُوْلَةٌ وَسَيِّئَاتِنَا مَغْفُوْرَةٌ كَقَوْلِ الْمُرْجِئَةِ. وَلَكِنْ نَقُوْلُ: الْمَسْأَلَةُ مُبَيَّنَةٌ مُفَصَّلَةٌ: مَنْ عَمِلَ حَسَنَةً بِجَمِيْعِ شَرَائِطِهَا خَالِيَةً عَنِ الْعُيُوْبِ الْمُفْسِدَةِ وَالْمَعَانِيْ الْمُبْطِلَةِ وَلَمْ يُبْطِلْهَا بِالْكُفْرِ وَالرِّدَّةِ وَالأَخْلاَقِ السَّيِّئَةِ حَتَّى خَرَجَ مِنَ الدُّنْيَا مُؤْمِناً فَإِنَّ اللهَ تَعَالَى لاَ يُضَيِّعُهَا بَلْ يَقْبَلُهَا مِنْهُ وَيُثِيْبُهُ عَلَيْهَا . وَمَا كَانَ مِنَ السَّيِّئَةِ دُوْنَ الشِّرْكِ وَالْكُفْرِ وَلَمْ يَتُبْ عَنْهَا صَاحِبُهَا حَتَّى مَاتَ مُؤْمِناً فَإِنَّهُ فِيْ مَشِيْئَةِ اللهِ تَعَالَى بِقَوْلِهِ إِنْ شَاءَ عَذَّبَهُ بِالنَّارِ، وَإِنْ شَاءَ عَفَا عَنْهُ وَلَمْ يُعَذِّبْهُ بِالنَّارِ أَصْلاً. وَالرِّيَاءُ إِذَا وَقَعَ فِيْ عَمَلٍ مِنَ الأَعْمَالِ فَإِنَّهُ يُبْطِلُ أَجْرَهُ، وَكَذَلِكَ الْعُجْبُ.
وَالآيَاتُ ثَابِتَةٌ لِلأَنْبِيَاءِ عَلَيْهِمُ الصَّلاَةُ وَالسَّلاَمُ، وَالْكَرَامَاتُ لِلأَوْلِيَاءِ حَقٌّ. وَأَمَّا الَّتِيْ تَكُوْنُ ِلأَعْدَائِهِ مِثْلِ إِبْلِيْسَ وَفِرْعَوْنَ وَالدَّجَّالِ مِِمَّا رُوِيَ فِيْ الأَخْبَارِ أَنَّهُ كَانَ وَيَكُوْنُ لَهُمْ لاَ نُسَمِّيْهَا آَيَاتٍ وَلاَ كَرَامَاتٍ، وَلكِنْ نُسَمِّيْهَا قَضَاءَ حَاجَاتٍ لَهُمْ، وَذَلِكَ ِلأَنَّ اللهَ تَعَالَى يَقْضِيْ حَاجَاتِ أَعْدَائِهِ اسْتِدْرَاجاً لَهُمْ وَعُقُوْبَةً لَهُمْ فَيَغْتَرُّوْنَ بِهِ وَيَزْدَادُوْنَ طُغْيَاناً وَكُفْراً، وَذَلِكَ كُلُّهُ جَائِزٌ وَمُمْكِنٌ. وَكَانَ اللهُ تَعَالَي خَالِقاً قَبْلَ أَنْ يَخْلُقَ، وَرَازِقاً قَبْلَ أَنْ يَرْزُقَ.
وَاللهُ تَعَالَي يُرَي فِيْ الآخِرَةِ، وَيَرَاهُ الْمُؤْمِنُوْنَ وَهُمْ فِيْ الْجَنَّةِ بِأَعْيُنِ رُؤُوْسِهِمْ بِلاَ تَشْبِيْهٍ وَلاَ كَيْفِيَّةٍ وَلاَ يَكُوْنَ بَيْنَهُ وَبَيْنَ خَلْقِهِ مَسَافَةٌ.
وَالإِيْمَانُ هُوَ الإِقْرَارُ وَالتَّصْدِيْقُ، وَإِيْمَانُ أَهْلِ السَّمَاءِ وَالأَرْضِ لاَ يَزِيْدُ وَلاَ يَنْقُصُ مِنْ جِهَةِ الْمُؤْمَنِ بِهِ، وَيَزِيْدُ وَيَنْقُصُ مِنْ جِهَةِ الْيَقِيْنِ وَالتَّصْدِيْقِ. وَالْمُؤْمِنُوْنَ مُسْتَوُوْنَ فِيْ الإِيْمَانِ وَالتَّوْحِيْدِ مُتَفَاضِلُوْنَ بِالأَعْمَالِ. وَالإِسْلاَمُ هُوَ التَّسْلِيْمُ وَالاِنْقِيَادُ ِلأَوَامِرِ اللهِ تَعَالَي. فَمِنْ طَرِيْقِ اللُّغَةِ فَرْقٌ بَيْنَ الإِيْمَانِ وَالإِسْلاَمِ. وَلَكِنْ لاَ يَكُوْنُ إِيْمَانٌ بِلاَ إِسْلاَمٍ، وَلاَ يُوْجَدُ إِسْلاَمٌ بِلاَ إِيْمَانٍ، وَهُمَا كَالظَّهْرِ مَعَ الْبَطْنِ، وَالدِّيْنُ اسْمٌ وَاقِعٌ عَلَي الإِيْمَانِ وَالإِسْلاَمِ وَالشَّرَائِعِ كُلِّهَا. نَعْرِفُ اللهَ تَعَالَي حَقَّ مَعْرِفَتِهِ كَمَا وَصَفَ اللهُ نَفْسَهُ فِيْ كِتَابِهِ بِجَمِيْعِ صِفَاتِهِ، وَلَيْسَ يَقْدِرُ أَحَدٌ أَنْ يَعْبُدَ اللهَ حَقَّ عِبَادَتِهِ كَمَا هُوَ أَهْلٌ لَهُ، وَلَكِنَّهُ يَعْبُدُهُ بِأَمْرِهِ كَمَا أَمَرَهُ بِكِتَابِهِ وَسُنَّةِ رَسُوْلِهِ ﷺ. وَيَسْتَوِيْ الْمُؤْمِنُوْنَ كُلُّهُمْ فِيْ الْمَعْرِفَةِ وَالْيَقِيْنِ وَالتَّوَكُّلِ وَالْمَحَبَّةِ وَالرِّضَا وَالْخَوْفِ وَالرَّجَاءِ وَالإِيْمَانِ فِيْ ذَلِكَ، وَيَتَفَاوَتُوْنَ فِيْمَا دُوْنَ الإِيْمَانِ فِيْ ذَلِكَ كُلِّهِ. وَاللهُ تَعَالَي مُتَفَضِّلٌ عَلَي عِبَادِهِ عَادِلٌ، قَدْ يُعْطِيْ مِنَ الثَّوَابِ أَضْعَافَ مَا يَسْتَوْجِبُهُ الْعَبْدُ تَفَضُّلاً مِنْهُ، وَقَدْ يُعَاقِبُ عَلَي الذَّنْبِ عَدْلاً مِنْهُ. وَقَدْ يَعْفُوْ فَضْلاً مِنْهُ.
وَشَفَاعَةُ الأَنْبِيَاءِ عَلَيْهِمُ السَّلاَمُ حَقٌّ، وَشَفَاعَةُ نَبِيِّنَا ﷺ لِلْمُؤْمِنِيْنَ الْمُذْنِبِيْنَ وَلأَهْلِ الْكَبَائِرِ مِنْهُم الْمُسْتَوْجِبِيْنَ الْعِقَابَ حَقٌّ ثَابِتٌ، وَوَزْنُ الأَعْمَالِ بِالْمِيْزَانِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ حَقٌّ، وَالْوَزْنُ وَالْقِصَاصُ فِيْمَا بَيْنَ الْخُصُوْمِ بِالْحَسَنَاتِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ حَقٌّ فَإِنْ لَمْ يَكُنْ لَهُمُ الْحَسَنَاتُ فَطَرْحُ السَّيِّئَاتِ عَلَيْهِمْ حَقٌّ جَائِزٌ. وَحَوْضُ النِّبِيِّ ﷺ حَقٌّ. وَالْجَنَّةُ وَالنَّارُ مَخْلُوْقَتَانِ الْيَوْمَ لاَ تَفْنَيَانِ أَبَداً. وَلاَ تَمُوْتُ الْحُوْرُ الْعِيْنُ أَبَداً، وَلاَ يَفْنَى عِقَابُ اللهِ تَعَالَي وَثَوَابُهُ سَرْمَداً.
বঙ্গানুবাদ
আমরা বলি না যে, পাপ মুমিনের কোনো ক্ষতি করবে না। আমরা এও বলি না যে, মুমিন জাহান্নামে প্রবেশ করবে না। আমরা এও বলি না যে, মুমিন অনন্তকাল জাহান্নামে থাকবে। মুমিন যদি ফাসিক বা পাপী হয় কিন্তু ঈমানসহ পৃথিবী ত্যাগ করে তবে তার বিষয়ে আমরা এরূপ বলি না। আমরা বলি না যে, আমাদের নেক কর্মগুলো কবুলকৃত এবং পাপরাশি ক্ষমাকৃত। মুরজিয়াগণ এরূপ বলে। বরং আমরা বলি যে, এ বিষয়টির বিস্তারিত ব্যাখ্যা রয়েছে। যে ব্যক্তি সকল শর্ত পূরণ করে এবং সকল বিনষ্টকারী ত্রুটি হতে মুক্ত থেকে কোনো নেক কর্ম করবে এবং কুফর বা ধর্মত্যাগ দ্বারা (বা অশোভন আচরণ দ্বারা)[1] তার নেককর্মটি বিনষ্ট করবে না এবং ঈমানসহ পৃথিবী ত্যাগ করবে আল্লাহ তার কর্মটি নষ্ট করবেন না, বরং তিনি তা কবুল করবেন এবং তাকে তার জন্য সাওয়াব প্রদান করবেন। কোনো মানুষ যদি শির্ক ও কুফর ছাড়া অন্য কোনো পাপ কর্ম করে তাওবা না করে ঈমানসহ মৃত্যুবরণ করে তবে তার বিষয়টি আল্লাহ তা‘আলার ইচ্ছাধীন থাকবে। মহান আল্লাহ ইচ্ছা করলে তাকে জাহান্নামের মধ্যে শাস্তি দিবেন, আর ইচ্ছা করলে তিনি তাকে ক্ষমা করবেন এবং তাকে জাহান্নামে কোনোরূপ শাস্তিই দিবেন না। রিয়া যদি কোনো কর্মের মধ্যে প্রবেশ করে তবে তা সে কর্মের পুরস্কার বাতিল করে দেয়। ‘উজব’ও তদ্রূপ।
নবীগণের জন্য ‘আয়াত’ প্রমাণিত। এবং ওলীগণের কারামত সত্য। আর ইবলীস, ফিরাউন, দাজ্জাল ও তাদের মত আল্লাহর দুশমনদের দ্বারা যে সকল অলৌকিক কর্ম সাধিত হয়, যে সকল অলৌকিক কর্মের বিষয়ে কুরআন-হাদীসে বর্ণিত হয়েছে যে, তাদের দ্বারা তা সংঘটিত হয়েছিল বা হবে, সেগুলোকে আমরা আয়াত বা কারামত বলি না, বরং এগুলোকে আমরা তাদের ‘কাযায়ে হাজাত’ বা প্রয়োজন মেটানো বলি। কারণ আল্লাহ তাঁর দুশমনদের প্রয়োজন মিটিয়ে দেন ‘ইসতিদরাজ’ হিসেবে -তাদেরকে তাদের পথে সুযোগ দেওয়ার জন্য- এবং তাদের শাস্তি হিসেবে। এতে তারা ধোঁকাগ্রস্ত হয় এবং আরো বেশি অবাধ্যতা ও অবিশ্বাসে নিপতিত হয়। এগুলি সবই সম্ভব।
মহান আল্লাহ স্রষ্টা ছিলেন সৃষ্টি করার পূর্ব থেকেই। তিনি রিয্কদাতা ছিলেন সৃষ্টিকে রিয্ক প্রদানের পূর্ব থেকেই। আর আখিরাতে মহান আল্লাহ পরিদৃষ্ট হবেন। জান্নাতের মধ্যে অবস্থানকালে মুমিনগণ তাঁকে দর্শন করবেন তাদের নিজেদের চর্মচক্ষু দ্বারা। এ দর্শন সকল তুলনা ও স্বরূপ-প্রকৃতি নির্ধারণ ব্যতিরেকে। মহান আল্লাহ ও তাঁর সৃষ্টির মধ্যে কোনো দূরত্ব হবে না।
ঈমান হচ্ছে (মুখের) স্বীকৃতি ও (অন্তরের) সত্যায়ন। বিশ্বাসকৃত বিষয়াদির দিক থেকে (আরকানুল ঈমানের দিক থেকে)) আকাশ ও পৃথিবীর অধিবাসীদের ঈমান বাড়ে না এবং কমে না, কিন্তু ইয়াকীন বা বিশ্বাসের দৃঢ়তা-গভীরতা ও সত্যায়নের দিক থেকে ঈমান বাড়ে এবং কমে।  এভাবে ঈমান ও তাওহীদের ক্ষেত্রে মুমিনগণ সকলেই সমান। কর্মের ক্ষেত্রে তাদের মর্যাদার হ্রাসবৃদ্ধি ঘটে।
ইসলাম অর্থ আল্লাহর নির্দেশের জন্য আত্মসমর্পন করা এবং অনুগত হওয়া। আভিধানিকভাবে ঈমান ও ইসলামের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। তবে বাস্তবে ও ব্যবহারে ইসলাম ছাড়া কোনো ঈমান হয় না এবং ঈমান ছাড়া ইসলামের অস্তিত্ব পাওয়া যায় না। কাজেই ঈমান ও ইসলাম হলো পিঠের সাথে পেটের ন্যায়। ঈমান, ইসলাম ও সমস্ত শরীয়তকে একত্রে দীন বলা হয়।
মহান আল্লাহর সত্যিকার মা’রিফাত (পরিচয়) আমরা লাভ করেছি, তিনি যেভাবে তাঁর কিতাবে তাঁর নিজের বর্ণনা দিয়েছেন সেভাবে তাঁর সকল বিশেষণ সহকারে। তবে কেউই মহান আল্লাহর সঠিক পরিপূর্ণ ইবাদত করতে সক্ষম নয়, যেরূপ ইবাদত তাঁর পাওনা। বান্দা তাঁর ইবাদত করে তাঁর নির্দেশ মত, যেভাবে তিনি তাঁর কিতাবে এবং তাঁর রাসূলের (ﷺ) সুন্নাতে নির্দেশ দিয়েছেন। মারিফাত (পরিচয় লাভ), ইয়াকীন (বিশ্বাস), তাওয়াক্কুল (নির্ভরতা), মহববত (ভালবাসা), রিযা (সন্তুষ্টি), খাওফ (ভয়), রাজা (আশা) এবং এ সকল বিষয়ের ঈমান-এর ক্ষেত্রে মুমিনগণ সকলেই সমান। তাদের মর্যাদার কমবেশি হয় মূল ঈমান বা বিশ্বাসের অতিরিক্ত যা কিছু আছে তার সবকিছুতে।
মহান আল্লাহ তাঁর বান্দাগণের উপর করুণাকারী ও ন্যায়বিচারক। তিনি মেহেরবানি করে অনেক সময় বান্দার প্রাপ্য সাওয়াবের চেয়ে অনেকগুণ বেশি পুরস্কার প্রদান করেন। কখনো তিনি ন্যায়বিচার হিসেবে পাপের শাস্তি প্রদান করেন। কখনো মেহেরবানি করে পাপ ক্ষমা করেন।
নবীগণের শাফা‘আত সত্য। পাপী মুমিনগণ এবং কবীরা গোনাহকারীগণের জন্য, পাপের কারণে যাদের জাহান্নাম পাওনা হয়েছিল তাদের জন্য কিয়ামাতের দিন আমাদের নবী (ﷺ)-র শাফা‘আতও সত্য। কিয়ামাতের দিন তুলাদন্ডে আমল ওযন করাও সত্য। কিয়ামাতের দিন বিবাদকারীদের মধ্যে পুণ্যকর্মের মাধ্যমে বদলার ব্যবস্থা করা সত্য। যদি তাদের সাওয়াব বা নেককর্ম না থাকে তবে পাওনাদারের পাপ তাদের উপর চাপিয়ে দেওয়ার বিষয়টিও সত্য ও সম্ভব। রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর হাউয সত্য। জান্নাত ও জাহান্নাম বর্তমানে সৃষ্ট অবস্থায় রয়েছে (পূর্বেই তাদের সৃষ্টি করা হয়েছে।) জান্নাত ও জাহান্নাম কখনোই বিলুপ্ত হবে না। আয়তলোচনা হূরগণ কখনোই মৃত্যুবরণ করবে না। মহান আল্লাহর অনন্ত-চিরস্থায়ী শাস্তি ও পুরস্কার কখনোই বিলুপ্ত হবে না।
-----------------------------------------------------------
[1] আল-ফিকহুল আকবারের কোনো কোনো পান্ডুলিপিতে এ অতিরিক্ত বাক্যাংশটি বিদ্যমান। ]
মুরজিয়াহ (المرجئة) ‘আরজাআ’ (أرجأ) ক্রিয়া থেকে গৃহীত। আরজাআ  (أرجأ) অর্থ বিলম্বিত করা, পিছিয়ে দেওয়া, স্থগিত রাখা (To postpone, adjourn) ইত্যাদি। মুরজিউন (مرجئ) অর্থ বিলম্বিতকারী বা স্থগিতকারী। বহুবচন বা ফিরকা অর্থে ‘মুরজিয়াহ’ বলা হয়, অর্থাৎ বিলম্বিতকারীগণ বা স্থগিতকারীগণ।
পূর্বের আলোচনায় আমরা দেখেছি যে, খারিজীদের মতে মুমিন পাপের কারণে কাফির হয়ে যান। যে মুমিন পাপ করে তাওবা ছাড়া মৃত্যু বরণ করবে সে অনন্তকাল জাহান্নামে থাকবে। তার ঈমান তার কোনো কাজে লাগবে না। মুতাযিলাগণও এরূপ বিশ্বাস পোষণ করে। তাদের মতে মুমিন তার ঈমান সত্ত্বেও যখন কোনো কবীরা গোনাহ করে তখন তার ঈমান ও সকল নেক কর্ম বিনষ্ট হয়ে যায়। এরূপ ব্যক্তি কাফির না হলেও মুমিন থাকে না। অর্থাৎ সে মুমিনও নয়, কাফিরও নয়। তবে পরিণতি কাফিরেরই। সেও কাফিরের মত অনন্তকাল জাহান্নামে শাস্তিভোগ করবে।
এদের মতে ইসলামের বিধান পালন ঈমানের অবিচ্ছেদ্য অংশ। কর্মের ঘাটতি মানেই ঈমানের ঘাটতি। আর ঈমানের ঘাটতি অর্থই কুফর। এর বিপরীতে আরেক দলের উদ্ভব হয়। তারা বলে, ঈমানের সাথে আমলের কোনো সম্পর্ক নেই। ঈমান থেকে আমল বা কর্ম সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন। ঈমানের জন্য শুধু অন্তরের ভক্তি বা বিশ্বাসই যথেষ্ট। ইসলামের কোনো বিধিবিধান পালন না করেও একব্যক্তি ঈমানের পূর্ণতার শিখরে আরোহণ করতে পারে। আর এরূপ ঈমানদার ব্যক্তির কবীরা গোনাহ তার কোনো ক্ষতি করে না। যত গোনাহই করুক না কেন সে জান্নাতী হবে। এদের মূলনীতি:
لاَ يَضُرُّ مَعَ الإِيْمَانِ مَعْصِيَةٌ كَمَا لاَ يَنْفَعُ مَعَ الْكُفْرِ طَاعَةٌ
‘‘ঈমান থাকলে কোনো পাপই কোনো ক্ষতি করে না, যেমন কুফর থাকলে কোনো পুণ্যই কাজে লাগে না।’’
দ্বিতীয় হিজরী শতকের প্রথম থেকেই এ মতটি বিশেষভাবে প্রসার লাভ করে। এদেরকে মুরজিয়া কেন বলা হলো সে বিষয়ে একাধিক ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। ইবনুল আসীর বলেন, এরা যেহেতু বিশ্বাস করে যে, কবীরা গোনাহে লিপ্ত ব্যক্তিকে আল্লাহ শাস্তি দিবেন না বা তার শাস্তি স্থগিত রাখবেন সেহেতু তাদেরকে মুরজিয়া বলা হয়। আর আব্দুল কাহির বাগদাদী বলেন, এরা যেহেতু আমল বা কর্মকে ঈমান থেকে বিচ্ছিন্ন করেছে বা স্থগিত করেছে এজন্য এদেরকে মুরজিয়া বলা হয়।[1]
খারিজীগণ যেরূপ কুরআন- হাদীসের কিছু বক্তব্য নিজেদের মতের ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করে তার বিপরীতে অন্য বক্তব্যগুলো ব্যাখ্যা বা বাতিল করেছে, মুরজিয়াগণও একইভাবে কুরআন ও হাদীসের ক্ষমা বিষয়ক ও তাওহীদের ফযীলত বিষয়ক বক্তব্যগুলোকে মূল ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করে বাকি আয়াত ও হাদীসগুলো ব্যাখ্যার মাধ্যমে বাতিল করেছে। সমন্বয় বা উভয় প্রকার শিক্ষা গ্রহণ করতে তারা সচেষ্ট হয় নি।
এখানে লক্ষণীয় যে, খারিজী, মুতাযিলী এবং তাদের সংগে একমত বিভিন্ন ফিরকা আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতকেও মুরজিয়াহ বলে আখ্যায়িত করে। কারণ এ সকল ফিরকা কবীরা গোনাহে লিপ্ত মুসলিমের বিধান তাৎক্ষণিক বলে দেয় যে, সে অনন্তকাল জাহান্নামে বাস করবে। আর আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামাআত কবীরা গোনাহে লিপ্ত ব্যক্তিকে অনন্ত জাহান্নামবাসী না বলে তার বিষয়টি আল্লাহর হাতে বলে বিশ্বাস করেন এবং আল্লাহ তাকে ইচ্ছা করলে শাস্তি না দিয়ে ক্ষমা করতে পারেন বলে বিশ্বাস করেন। এভাবে তাঁরা পাপী মুসলিমের বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের বিষয়টি পিছিয়ে দেন।
বস্ত্তত ‘আহলুস সুন্নাত’ কুরআন ও হাদীসের সকল নির্দেশ সমানভাবে গ্রহণ করেছেন। তাঁরা কিছু আয়াত ও হাদীসকে অগ্রগণ্য করে অন্য আয়াত ও হাদীসকে ব্যাখ্যার নামে বাতিল করেন নি। বরং তাঁরা উভয় অর্থের ওহী সমানভাবে বিশ্বাস ও গ্রহণ করেছেন। আর এ বিষয়টি ব্যাখ্যা করে ইমাম আবূ হানীফা (রাহ) বলেছেন:
আমরা বলি না যে, পাপ মুমিনের কোনো ক্ষতি করবে না। আমরা এও বলি না যে, মুমিন জাহান্নামে প্রবেশ করবে না। আমরা এও বলি না যে, মুমিন অনন্তকাল জাহান্নামে থাকবে। মুমিন যদি ফাসিক বা পাপী হয়, কিন্তু ঈমানসহ পৃথিবী ত্যাগ করে তবে তার বিষয়ে আমরা এরূপ বলি না।  আমরা বলি না যে, আমাদের নেক কর্মগুলি কবুলকৃত এবং পাপরাশি ক্ষমাকৃত, মুরজিয়াগণ এরূপ বলে থাকে।
বরং আমরা বলি যে, এ বিষয়টি বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যাকৃত। যে ব্যক্তি সকল শর্ত পূরণ করে এবং সকল বিনষ্টকারী ত্রুটি হতে মুক্ত থেকে কোনো নেক কর্ম করবে এবং কুফর বা ধর্মত্যাগ দ্বারা বা অশোভন আচরণ দ্বারা তার নেককর্মটি বিনষ্ট করবে না এবং ঈমানসহ পৃথিবী ত্যাগ করবে আল্লাহ তার কর্মটি নষ্ট করবেন না, বরং তিনি তা কবুল করবেন এবং তাকে তার জন্য সাওয়াব প্রদান করবেন।
কোনো মানুষ যদি শির্ক ও কুফর ছাড়া অন্য কোনো পাপ কর্ম করে তাওবা না করে ঈমান সহ মৃত্যুবরণ করে তবে তার বিষয়টি আল্লাহ তা‘আলার ইচ্ছাধীন থাকবে। মহান আল্লাহ ইচ্ছা করলে তাকে জাহান্নামের মধ্যে শাস্তি দিবেন, আর ইচ্ছা করলে তিনি তাকে ক্ষমা করবেন এবং তাকে জাহান্নামে কোনোরূপ শাস্তিই দিবেন না। রিয়া যদি কোনো কর্মের মধ্যে প্রবেশ করে তবে তা সে কর্মের পুরস্কার বাতিল করে দেয়। ‘উজব’ও তদ্রূপ।
এ বিষয়ে ইমাম আবূ হানীফা (রাহ) ও তাঁর সাথীদ্বয়ের আকীদা আরো বিস্তারিত ব্যাখ্যা করেছেন ইমাম তাহাবী। তিনি বলেন:
وَلا نَقُولُ: لا يَضُرُّ مَعَ الإِيمَانِ ذَنْبٌ لِمَنْ عَمِلَهُ. نَرْجُو لِلْمُحْسِنِينَ مِنَ الْمُؤْمِنِينَ أَنْ يَعْفُوَ عَنْهُمْ، وَيُدْخِلَهُمُ الْجَنَّةَ بِرَحْمَتِهِ، وَلا نَأْمَنُ عَلَيْهِمْ، وَلا نَشْهَدُ لَهُمْ بِالْجَنَّةِ، وَنَسْتَغْفِرُ لِمُسِيئِهِمْ، وَنَخَافُ عَلَيْهِمْ، وَلا نُقَنِّطُهُمْ. ... وَالأَمْنُ وَالإِيَاسُ يَنْقُلانِ عَنْ مِلَّةِ الإِسْلامِ، وَسَبِيلُ الْحَقِّ بَيْنَهُمَا لأَهْلِ الْقِبْلَةِ. ....  وَأَهْلُ الْكَبَائِرِ مِنْ أُمَّةِ مُحَمَّدٍ ﷺ فِي النَّارِ لاَ يَخْلُدُونَ، إِذَا مَاتُوا وَهُمْ مُوَحِّدُونَ، وَإِنْ لَمْ يَكُونُوا تَائِبِينَ، بَعْدَ أَنْ لَقُوا اللَّهَ عَارِفِينَ مُؤْمِنِينَ، وَهُمْ فِي مَشِيئَتِهِ وَحُكْمِهِ إِنْ شَاءَ غَفَرَ لَهُمْ، وَعَفَا عَنْهُمْ بِفَضْلِهِ، كَمَا ذَكَرَ عَزَّ وَجَلَّ فِي كِتَابِهِ: "وَيَغْفِرُ مَا دُونَ ذَلِكَ لِمَنْ يَشَاءُ"، وَإِنْ شَاءَ عَذَّبَهُمْ فِي النَّارِ بِعَدْلِهِ، ثُمَّ يُخْرِجُهُمْ مِنْهَا بِرَحْمَتِهِ وَشَفَاعَةِ الشَّافِعِينَ مِنْ أَهْلِ طَاعَتِهِ، ثُمَّ يَبْعَثُهُمْ إِلَى جَنَّتِهِ، وَذَلِكَ بِأَنَّ اللَّهَ تَعَالَى تَوَلَّى أَهْلَ مَعْرِفَتِهِ، وَلَمْ يَجْعَلْهُمْ فِي الدَّارَيْنِ كَأَهْلِ نُكْرَتِهِ الَّذِينَ خَابُوا مِنْ هِدَايَتِهِ، وَلَمْ يَنَالُوا مِنْ وَلايَتِهِ.
‘‘আমরা এ কথাও বলি না যে, ঈমান থাকলে কোনো পাপ পাপীর ক্ষতি সাধন করে না। মু‘মিনগণের মধ্যে যারা সৎকর্মশীল ইহসান অর্জনকারী নেককার তাদের সম্পর্কে আমরা আশা করি যে, আল্লাহ্ পাক তাদের দোষক্রটি ক্ষমা করবেন এবং নিজ রহমতে তাদেরকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন। তবে, আমরা তাদের সম্পর্কে সম্পুর্ণ নির্ভয় নই এবং তাদের জান্নাতী হওয়ার কোনো সাক্ষ্যও আমরা প্রদান করি না। আর মুমিনগণের মধ্যে যারা গুনাহগার তাদের ভূলক্রটির জন্য আমরা আল্লাহর নিকট মাগফেরাত কামনা করি এবং তাদের ব্যাপারে আশঙ্কাও পোষণ করি। তবে, আমরা তাদেরকে নিরাশাগ্রস্থ করি না।
নির্ভয় ও হতাশা উভয়ই বান্দাকে মিল্লাতে ইসলাম থেকে দূরে সরিয়ে নেয়। আহলু কিবলার জন্য এতদুভয়ের মাঝামাঝি সত্যের পথ নিহিত রয়েছে। .... মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর উম্মতের মধ্যে যারা কবীরা গুণাহ করবে তারা জাহান্নামে চিরকাল থাকবে না, যদি তারা তাওহীদের সাথে মৃত্যু বরণ করে, যদিও তারা তাওবা না করে মারিফাত ও ঈমানসহ আল্লাহর সাথে সাক্ষাত করে থাকে। তাদের পরিণতি আল্লাহর ইচ্ছা ও নির্দেশের উপর নির্ভর করবে। তিনি চাইলে নিজ দয়ায় তাদের ক্ষমা করে দিবেন। কুরআন কারীমে মহান আল্লাহ বলেন: ‘‘এবং তিনি শিরক ব্যতীত অন্যান্য অপরাধ যাকে ইচ্ছা ক্ষমা করেন।’’[2] আর তিনি চাইলে আপন ন্যায়বিচারের ভিত্তিতে তাদের জাহান্নামে শাস্তি দিতে পারেন। অতঃপর তিনি নিজ অনুগ্রহে এবং তাঁর অনুগত বান্দাহগণের শাফা‘আতের ফলে তাদের বের করে জান্নাতে পাঠাবেন। এর কারণ, আল্লাহ তা’আলা তাঁর ঈমানদার বান্দাহগণের অভিভাবকত্ব বিশেষভাবে গ্রহণ করেছেন। তাদের ইহকাল ও পরকালে ঐসব কাফেরদের সমতুল্য করেন নি যারা তাঁর হেদায়াত থেকে নিজেদের বঞ্চিত করেছে এবং তাঁর বন্ধুত্ব ও অভিভাবকত্ব লাভে সক্ষম হয় নি।’’[3]
-----------------------------------------------------
[1] ইবনুল আসীর, আন-নিহাইয়া ১/৯৮; বাগদাদী, আল-ফারকু বাইনাল ফিরাক, পৃ. ২০২। [2] সূরা (৪) নিসা: ৪৮ ও ১১৬ আয়াত। [3] তাহাবী, আল-আকীদাহ, পৃ. ১৩-১৫। ]
সূত্রঃ
আল-ফিকহুল আকবার
ডক্টর খন্দকার  আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

সয়তান ও নারীর চক্রান্ত

হিন্দুস্তানের যুদ্ধ - গাযওয়াতুল হিন্দ

জিহাদ ''হাদিসের অপব্যাখ্যা ও বিভ্রান্তির জবাব''