দলবদ্ধভাবে উচ্চস্বরে জিকির করা সুন্নাহ বিরোধী কাজ


ইসলামী শরীয়তে জিকির অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি ইবাদত। কিন্তু আমাদের দেশের পীর সাহেবগণ জিকিরের বিভিন্ন রকম পদ্ধতি তৈরি করেছেন। কুরআন ও হাদিসের দিক নির্দেশনার বাইরে গিয়ে যে যার ইচ্ছামত বিভিন্ন রকম জিকিরের প্রচলন করেছেন। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ও বহুল প্রচলিত একটি পদ্ধতি হচ্ছে দলবদ্ধভাবে উচ্চস্বরে জিকির করা। অথচ এভাবে জিকির করার নির্দেশনা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কখনো দেন'নি এবং সাহাবায়ে কেরাম কখনো এ ধরনের জিকিরের মজলিসের আয়োজন করেন নি। বরং সর্বপ্রথম যখন এ ধরনের জিকিরের বিদ’আত শুরু হয় তখন সাহাবীগণ এর কঠোর প্রতিবাদ করেছিলেন। নিম্নে এ সম্পর্কিত একটি ঘটনা উল্লেখ করা হলঃ
আমর বিন ইয়াহইয়া হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমার পিতাকে আমার দাদা হতে বর্ণনা করতে শুনেছি, তিনি বলেন, আমরা একবার ফজরের নামাজের পূর্বে আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ) এর ঘরের দরজার সামনে বসা ছিলাম। উদ্দেশ্য হল তিনি যখন বের হবেন, আমরা তার সাথে পায়ে হেঁটে মসজিদের দিকে যাত্রা করব। এমন সময় আমাদের কাছে আবু মূসা আশআরী (রাঃ) আগমন করে বললেন, আবু আব্দুর রহমান (ইবনে মাসউদের উপনাম) কি বের হয়েছেন? আমরা বললাম, এখনও বের হন নি। তিনিও আমাদের সাথে বসে গেলেন। তিনি যখন বের হলেন, আমরা সকলেই তাঁর কাছে গেলাম। আবু মূসা আশআরী (রাঃ) বললেন, হে আবু আব্দুর রহমান, আমি মসজিদে এখনই একটি নতুন বিষয় দেখে আসলাম। আলহামদূলিল্লাহ এতে খারাপ কিছু দেখি নি। তিনি বললেন সেটি কি? আবু মূসা (রাঃ) বললেন, আপনার হায়াত দীর্ঘ হলে আপনিও তা দেখতে পাবেন। তিনি বললেন, আমি দেখলাম মসজিদে একদল লোক গোলাকার হয়ে বসে নামাজের অপেক্ষা করছে। সেই দলের মাঝখানে একজন লোক রয়েছে। আর সবার হাতে রয়েছে ছোট ছোট পাথর। মাঝখানের লোকটি বলছে, একশতবার আল্লাহু আকবার পাঠ কর। এতে সকলেই একশতবার আল্লাহু আকবার পাঠ করে। তারপর বলে একশতবার লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ পাঠ কর। এ কথা শুনে সবাই একশতবার লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ পাঠ করে থাকে। তারপর লোকটি বলে এবার একশতবার সুবাহানাল্লাহ পাঠ কর। সবাই একশতবার সুবহানাল্লাহ পাঠ করে থাকে। এ কথা শুনে ইবনে মাসউদ (রাঃ) বললেন, তুমি তাদেরকে তাদের পাপের কাজগুলো গণনা করে রাখতে বললে না কেন? আর এটা বললে না কেন যে তাদের নেকীর কাজগুলো থেকে একটি নেকীও নষ্ট হবে না। কাজেই এগুলো হিসাব করে রাখার কোন দরকার নেই।
অতঃপর ইবনে মাসউদ (রাঃ) চলতে থাকলেন। আমরাও তার সাথে চললাম এবং একটি হালাকার (বৈঠকের) কাছে এসে উপস্থিত হলাম। তিনি তাদের কাছে দাড়িয়ে বললেন, একি করছ তোমরা? তারা সবাই বলল পাথরের মাধ্যমে গণনা করে আমরা তাকবীর, তাসবীহ ইত্যাদি পাঠ করছি। ইবনে মাসউদ (রাঃ) বললেন, তাহলে তোমরা তোমাদের পাপের কাজগুলোর হিসাব কর। কারণ পাপের কাজগুলো হিসাব করে তা থেকে তওবা করা দরকার। আমি এ ব্যাপারে জিম্মাদার হলাম যে, তোমাদের ভাল কাজগুলোর একটি ভাল কাজও নষ্ট হবে না। এ কথা বলার কারণ এই যে, আল্লাহর কাছে কারো আমল বিনষ্ট হয় না। বরং একটি আমলের বিনিময়ে দশটি সাওয়াব দেওয়া হয় এবং দশ থেকে সাত শত গুণ পর্যন্ত বাড়িয়ে দেওয়া হয়। তারপর তিনি বললেনঃ হে মুহাম্মাদের উম্মত, অমঙ্গল হোক তোমাদের। কিসে তোমাদেরকে এত তাড়াতাড়ি ধ্বংসের পথে নিয়ে যাচ্ছে? এখনও নবী মুহাম্মাদের অসংখ্য সাহাবী জীবিত আছেন। এই তো রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর কাপড় এখনও পুরাতন হয় নি। তাঁর ব্যবহারকৃত থালা বাসন গুলো এখনও ভেঙ্গে যায় নি। ঐ সত্তার শপথ যার হাতে আমার প্রাণ রয়েছে, তোমরা যে দ্বীন তৈরি করেছ তা কি মুহাম্মাদের দ্বীন হতে উত্তম? না তোমরা গোমরাহির দ্বার উন্মুক্ত করেছ? তারা বললঃ হে আবু আব্দুর রহমান, আমরা এর মাধ্যমে কল্যাণ ছাড়া অন্য কোন ইচ্ছা করি নি। তিনি বললেন, অনেক কল্যাণকামী আছে যে তার উদ্দেশ্য পর্যন্ত পৌছতে পারে না। আল্লাহর নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমাদেরকে সংবাদ দিয়েছেন যে, একটি দল কুরআন তিলাওয়াত করবে কিন্তু কুরআন তাদের কণ্ঠনালীর ভিতরে প্রবেশ করবে না। আল্লাহর শপথ করে বলছি মনে হয় তাদের অধিকাংশই তোমাদের থেকে বের হবে। অতঃপর ইবনে মাসউদ (রাঃ) তাদেরকে ছেড়ে চলে আসলেন। আমর ইবন সালামা (রাঃ) বলেন, আমরা তাদের অধিকাংশকেই দেখলাম নাহরাওয়ানের যুদ্ধে খারেজীদের সাথে আমাদের বিরুদ্ধে একত্রিত হয়েছে।
(সুনান আদ দারেমী ' হা নং ২১০ । হাদিসের মান- হাসান ) 
এখানে কয়েকটি কারণে ইবন মাসউদ (রাঃ) এ ভাল কাজগুলো অপছন্দ করেছেন। প্রথমতঃ তাসবীহ পাঠ করার জন্য গোলাকার হয়ে বসা। দ্বিতীয়তঃ তাসবীহ সমূহের সংখ্যা ১০০ নির্ধারণ করা। তৃতীয়তঃ পাথরের মাধ্যমে হিসাব করে এগুলো পাঠ করা। কেননা তাসবীহ পাঠের উল্লেখিত পদ্ধতির কোনটিই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে প্রমাণিত নয়। সূফীদের যত জিকির রয়েছে তার সবই বানোয়াট এবং বিদ’আতি জিকির। কেননা এগুলো সবই হাদিসে বর্ণিত শরীয়ত সম্মত জিকিরের পরিপন্থী। তাছাড়া দলবদ্ধ হয়ে উচ্চস্বরে বা চিৎকার করে জিকির করা বা হালাকায়ে জিকির করা যেমনঃ লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ এর জিকির, আল্লাহু আল্লাহু বলে জিকির করা, জিকিরে যলী, জিকিরে খফী, জিকিরে রূহী, জিকিরে কলবী ইত্যাদি সবই ইবাদতের নামে নতুন সৃষ্টি তথা বিদ’আত বা ইসলাম বিরোধী কাজ।
সুতরাং জিকিরের ক্ষেত্রে মূলনীতি হল, প্রত্যেক ব্যক্তি হাদিসে বর্ণিত জিকিরগুলো একা একা পাঠ করবে। সালাত শেষে বা সালাতের আগে দলবদ্ধভাবে জিকির করা বিদ’আত যা ইসলাম সমর্থন করে না। তাই এ সব কাজ আমাদের পরিত্যাগ করতে হবে।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

সয়তান ও নারীর চক্রান্ত

হিন্দুস্তানের যুদ্ধ - গাযওয়াতুল হিন্দ

জিহাদ ''হাদিসের অপব্যাখ্যা ও বিভ্রান্তির জবাব''